অস্তিত্ব

শুন্যতা (অক্টোবর ২০১৩)

ইন্দ্রাণী সেনগুপ্ত
  • ১৫
ঘন্টাখানেক হল লোডশেডিং হয়েছে। তবে, আজ আর গরমে হাসফাস নেই। দিন পনেরোর প্রচন্ড দাবদাহ থেকে মুক্তি দিয়ে গেল বিকেলের কালবৈশাখী। দুপুর পর্য্যন্তও কড়া রোদ ছিল। বৃষ্টিপাতের কোন সম্ভাবনাও দেখেননি আবহবিদরা। আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য ভুল প্রমান করে দুপুরের পর থেকেই আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল প্রকৃতি, আর সাথে প্রকৃতি নির্ভর প্রানসমূহও।

শীতল প্রকৃতির ছোঁয়ায় বারান্দার ইজিচেয়ারটায় গা এলিয়ে বসে আছে চারু। বসেই আছে, বোধহয় ঘন্টা তিনেক, অথবা, আরো বেশি। সময়ের হিসেব কখন যেন হারিয়ে গেছে, অথবা, হারিয়ে গেছে হিসেবি মনটাই। বিগত কয়েকদিনের আলাপচারিতায় তার সবথেকে কাছের মানুষ হয়ে ওঠা চরিত্রগুলি হল সত্যবতী, সুবর্ণলতা আর বকুল। তিনটি ভিন্ন সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপটে আশাপূর্ণাদির হাতে গড়ে ওঠা তিনটি জীবন, অথবা তিনটি সময়ের প্রতিনিধি বা প্রতিচ্ছবি। ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা তিনটি ভিন্ন জীবনের একমাত্র অভিন্নতার স্থান হল মনন ও চিন্তাশক্তি। আর ঠিক এই স্থানেই নিজেকে আবিষ্কার করে চারু। কোথায় যেন বাঁধা পড়ে গেছে চারুর জীবনও সত্যবতী, সুবর্ণ বা বকুলের সাথে। এই অভিন্নতার জন্যই বোধহয় তাদের বড় কাছের মানুষ মনে হয় চারুর।

মেয়েবেলা থেকে বড়দের মুখে একটা কথা প্রায়ই শুনেছে চারু। মেয়েরা নাকি জলের মত, যখন যে পাত্রে রাখা হবে সেই পাত্রের আকার নেবে। তার অর্থ হল, মেয়েদের নিজস্ব কোন আকৃতি বা বৈশিষ্ট থাকা উচিত নয়। সকলের সাথে, সকল পরিস্থিতির সাথে ‘মানিয়ে’ নিয়ে থাকতে পারাটাই হল আদর্শ মেয়ের পরিচয়। এই জায়গাটাতেই নিজেকে মেলাতে পারে না চারু। এই সেদিন কথা হচ্ছিল মধুরিমার সাথে। কি অদ্ভুত ভাবে বদলে যেতে পারে মানুষ। অথবা, বদলে যাওয়ার অর্থই কি জীবন! একদা কলেজ ইউনিয়ানের নের্তৃস্থানীয় মেয়েটির জীবন এখন আবর্তিত হয় শুধুমাত্র বরের প্রতিষ্ঠা আর ছেলের স্বাস্থকে কেন্দ্র করে। ঘন্টাখানেক ফোনে কথা বলার মধ্যে একবারের জন্যও নিজের কথা বলল না একটাও। ওরাই তো একদিন মেতেছিল সমাজকে বদলে দেওয়ার নেশায়। আদর্শটাই কি ভ্রান্ত ছিল তবে!

চারু বোধ করি স্বার্থপর। চারু ভালবাসে নিজেকে, নিজের সৃষ্টিকে, নিজের চিন্তাশক্তিকে। পারিপার্শ্বিকতাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মেয়েরা কত মহৎ সৃষ্টি ঈশ্বরের। ঈশ্বর তাদের দিয়েছেন সহনশীলতা, মায়া-মমতায় ভরা প্রাণ, অথচ, সবটুকুই অন্যের স্বার্থরক্ষায়। তাই তো, সংসার নামক যাত্রাপালায় সং সেজে অভিনয় করতে করতে মেয়ে নামক প্রজাতিটির আলাদা কোন অস্তিত্বই আর থাকে না। ‘মেয়ে-মানুষের’ ঊর্ধ্বে উঠে শুধু মানুষ হিসেবে যে একটা গোটা পরিচয় ছিল, সেটাই হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে। এটাই নিয়ম, এটার সাথেই সকলে পরিচিত। পরিচিত চারুর মা-দিদিমা,মধুরিমা, বা আরো অনেকে। চারুই শুধু মেলাতে পারে না নিজেকে যেমন পারে নি আজ থেকে কত কত যুগ আগে সত্যবতী, সুবর্ণ বা বকুলের প্রতিচ্ছবি স্বরূপ মেয়েরাও। প্রত্যেক যুগেই জন্ম নেয় ওরা, যারা ভালবাসে নিজস্বতা, সৃজনশীলতা, সর্বোপরি ভালবাসে নিজের বৈশিষ্ট আর অস্তিত্বকে। অন্যের অস্তিত্বের মাঝে বেঁচে থাকাকে যারা ঘৃণা করে। ওরা স্বার্থপর, ওরা তথাকথিত ‘মেয়ে মানুষের’ নামে কলঙ্ক । যুগ যুগ ঘরে বয়ে চলে এই প্রবাহ । ‘পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য’ বা ‘পতি পরম গুরু’ – নামক বেদবাক্য বিশেষের ক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলে যে নারী, সে কিভাবে আদর্শ হতে পারে সমাজে! চারুরা পারে না আদর্শ স্ত্রী,পুত্রবধু বা মা হয়ে উঠতে যেমন পারে নি সত্যবতী বা সুবর্ণলতাও।

হঠাৎ ফোনের আওয়াজে সম্বিত ফেরে চারুর। ওপারে অপেক্ষমান সুবীর। ফোন ধরার সাথে সাথেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর – ‘এতবার করে ফোন করছি, ধরছ না কেন’! কতবার ফোন করেছে সুবীর! রিং তো এই প্রথমবার শুনতে পেল চারু – ‘খেয়াল করিনি, বোধহয় চোখটা একটু লেগে এসেছিল’। - ‘কি যে কর না’!! – খানিকটা নিশ্চিন্ত শোনাল সুবীরের কন্ঠস্বর। ভাল লাগে চারুর এই মুহূর্তগুলো। বিবাহিত জীবনের সূচনাপর্ব আসন্নপ্রায়। কিন্তু, তারপর! নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে চারু! না কি,আবার ফিরে আসবে সেই ‘মেয়েমানুষের’ সংজ্ঞা! নিজের অস্তিত্বের তাগিদে সুবর্ণরাও তো এই দোলাচলে কাটিয়ে দিয়েছে যুগের পর যুগ। আদর্শ স্ত্রী বা মায়ের আদর্শ হয়ে উঠতে পারে নি তো কখনো। তবুও তো থেকে যায় ভালবাসা, নিজের পরিবারকে, নিজের ঘরকে, সর্বোপরি নিজের অস্তিত্বকে। চারুও ভালবাসে সুবীরকে, তবে নিজেকে বাদ দিয়ে নয়। অবাক বিস্ময়ে ভাবে চারু, আজও সুবীররা মেয়েমানুষের ঊর্ধ্বৈ উঠে মানুষ দেখতে শিখল না। সুবর্ণর স্বামী আর চারুর সুবীরও একাকার হয়ে যায় একটি স্থানে। কাছে থেকেও কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পারে না ওরা কোনদিনও। আর, তাই থেকে যায় বিশাল একটা শূণ্যস্থান যেখানে বিচরন করে চারুর মনের কাছাকাছি মানুষগুলো, হয়তো বা ছায়াসঙ্গী হিসেবেই।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ইসহাক খান নারীপুরুষ উভয়েই সৃষ্টিকর্তার মহান সৃষ্টি। শুভেচ্ছা রইলো।
মিলন বনিক না কি,আবার ফিরে আসবে সেই ‘মেয়েমানুষের’ সংজ্ঞা! আসলে আমার মনে হয় মেয়েরাই ”মেয়েমানুষের” সংজ্ঞা থেকে ”মানুষের” সংজ্ঞায় বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়..সমাজ ব্যেযবস্ভাথায় বে গড়ে উঠে জন্মের পর থেকে ছেলে মেয়ের তারতম্য...খুব ভালো লাগলো....
একদম ঠিক বলেছেন। মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের অপমান করে চলে প্রতিনিয়ত। আর দুঃখের বিষয়, সেটা তারা নিজেরাই বোঝে না !!
Jontitu ভালো লিখেছেন। ভালো লাগলো।
ছন্দদীপ বেরা সুন্দর । ভাল লাগল । বেশ লেখা ।
শাহীন মাহমুদ ছোট গল্প না বলে অনু গল্প বললাম------ বিষয় আপেক্ষিক সময়ের বিতকের দিকে না গিয়ে শুধু এ টুকু বল্বু লিখার বুনন সুন্দর--- ভাল থাকবেন।
সূর্য নারী-পুরুষের অবস্থানগত দ্বন্ধের কিছু ব্যাপার অবশ্য আপেক্ষিক। তার পরও বহুবছরের চর্চায় গড়ে ওঠা অবস্থান শুধু চেয়েচিন্তে বদলাবার সুযোগটা নেই, সেটা করতে হবে চিন্তা, চেতনা এবং কর্মে তার প্রয়োগের মাধ্যমেই। সুন্দর বুননের প্রশংসা করতেই হয়।
ঐশিকা বসু গদ্য হিসাবে খুব সুন্দর লিখেছেন। ভাষার প্রয়োগক্ষমতার প্রশংসা করি।
বশির আহমেদ নারী পুরুষ দ্বন্দের একটা চির চেনা চিত্র সুন্দর সাবলিল ভাবে আপনার লেখায় ফুটে উঠেছে । চারুর মত স্বাধীনচেতা নারীরা শেষ পর্যন্ত কি পারবে সমাজ ও নারী চরিত্রের চিরচেনা রূপটাকে বদলাতে ?
এশরার লতিফ লেখার ভঙ্গিটি চমৎকার। বিষয়টিও। মেয়েদের পুরোপুরি স্বাধীনতা এবং সমমর্যাদা বেশীরভাগ পুরুষ কখনোই দেবে না কারন এতে তারা একটা বিরাট প্রাকৃতিক শক্তিকে উন্মুক্ত করে দেয়ার নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এটা মেয়েদেকেই অর্জন করতে হবে।
রোদের ছায়া গল্পের ভাজে ভাজে নারী জীবনের এক চিরকালিন দ্বন্দ্ব , তাকে ঘিরে সৃষ্ট শুন্যতা বেশ মনে দাগ কাঁটার মতই লেখা। পরিসর একটু ছোট হয়ে গেলো বলে হয়তো ঠিক গল্প হয়ে উঠে পারল না লেখাটি । তবে ভালো লাগলো।

২৩ এপ্রিল - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ১৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪